ইলহাম শিরক নয়, বরং তা সত্য এবং সহীহ দলিল দ্বারা প্রমাণিত - ইলহাম শরীয়তের কোন দলীল নয় ilham-shirk-or-not?

 - Umar Bin Khattab


আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, তিনিই একমাত্র গায়েব জানেন। কিন্তু কুরন ও হাদীসের কোথাও এই কথা বলা নেই যে, তিনি গায়েবের বিষয়গুলো অন্য কাউকে জানাবেন না। তিনিই একমাত্র গায়েব জানেন এটি যেমন সত্য, তেমনি আল্লাহ তায়ালা গায়েবের অনেক বিষয় মাখলুককেও জানান, সেটিও সত্য। অর্থাৎ গায়েবের বিষয়ে মাখলুকের কোন স্বাধীন জ্ঞান নেই। গায়েবের বিষয় সম্পর্কে জানার নিজস্ব কোন ক্ষমতা মাখলুকের নেই। কেউ যদি দাবী করে যে, সে চাইলেই গায়েবের যে কোন বিষয় সম্পর্কে জেনে নিতে পারে তাহলে তা হবে সুস্পষ্ট শিরক। এটি সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার উপর নিভর্শীল। তিনি কাকে, কখন, কোথায় কোন গায়েব সম্পর্কে জানাবেন একমাত্র তিনিই ভালো জানেন।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলদেরকে ওহী পাঠানোর মাধ্যমে গায়েব সম্পর্কে অবহিত করতেন আর তাঁর অন্যান্য প্রিয় বান্দাদের স্বপ্ন এবং ইলহামের মাধ্যমে গায়েব সম্পর্কে অবহিত করেন। ইলহামের পারিভাষিক অর্থ হল, চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়াই কোন কথা অন্তরে উদ্রেক হওয়া। ইলহামও স্বপ্নের ন্যায় কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, আবার কখনো শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। যে ইলহাম শরীয়তের হুকুম আহকাম সম্পর্কিত নয় বা যে ইলহাম শরীয়তের কোন হুকুম আহকাম সম্পর্কিত কিন্তু এর পক্ষে শরীয়তের দলীলও বিদ্যমান থাকে, শুধু এ ধরনের ইলহামকেই সহীহ ইলহাম বলা হবে এবং ধরা হবে এটি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হয়েছে। এটি আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত বলে পরিগণিত হবে। আর যদি ইলহামে উপরোক্ত শর্তগুলো না পাওয়া যায় তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে, তা শয়তানের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। এ ধরনের ইলহাম থেকে বিরত থাকা এবং তা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা আবশ্যক। [ফাতহুল বারী, ১২/৪০৫ ।। কিতাবুত তাবীর, বাব ১০]

তবে মনে রাখতে হবে ইলহাম বা স্বপ্ন শরীয়তের কোন দলীল নয়। বরং শরীয়তের অন্যান্য দলীল অর্থাৎ কুরআন সুন্নাহ ইজমা কিয়াস ইত্যাদির আলোকে ইলহাম ও স্বপ্নের বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলগণ ব্যতীত অন্যান্য বান্দাদেরকেও গায়েব সম্পর্কে অবহিত করেন এ সম্পর্কিত কিছু দলিল প্রমাণ নিম্নে বর্ণনা করা হলঃ

১) আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে হযরত মারইয়াম আঃ এর ঘটনা উল্লেখ করেছেনঃ সে বলল, নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রভূর প্রেরিত দূত। আমি তোমাকে পবিত্র একটি ছেলে দেওয়ার জন্য এসেছি। [সূরা মারইয়াম, আয়াত নং ১৯]

সর্বজন বিদিত একটি বিষয় হলো, হযরত মারইয়াম আঃ আল্লাহর নবী বা রাসূল ছিলেন না। তিনি একজন সত্যবাদী বিদূষী নারী ছিলেন। সুতরাং তিনি যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত হয়েছেন, সেটি জিবরাইল আঃ এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জানিয়েছেন।

২) হযরত মূসা আঃ এর মায়ের ঘটনা প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ আমি মূসার মায়ের কাছে ওহী পাঠালাম যে, তুমি তাকে দুধ পান করাতে থাকো। যখন তুমি তার জীবনের ব্যাপারে আশঙ্কা করবে, তাকে সাগরে নিক্ষেপ করবে আর তুমি কোন চিন্তা ও ভয় করবে না। নিশ্চয়ই আমিই তাকে তোমার নিকট ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে আমার রাসূলদের অন্তর্ভূক্ত করবো। [সূরা কাসাস, আয়াত ৭]

হযরত মূসা আঃ এর মা নবী ছিলেন না। তার নিকট আল্লাহ তায়ালা যে সংবাদ পাঠিয়েছেন এটিও একটি গায়েবের সংবাদ। অর্থাৎ আমি তাকে তোমার নিকট ফিরিয়ে আনবো এবং তাকে রাসূলদের অন্তর্ভূক্ত করবো, এটি নিরেট গায়েবের বিষয়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা আঃ এর মাকে এটি পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছেন।

৩) আল্লাহ তায়ালা সূরা কাহাফে হযরত খিজির আঃ এর সম্পর্কে বলেছেনঃ অতঃপর তারা উভয়ে আমার একজন নেককার বান্দার দেখা পেল, যাকে আমি আমার রহমত দান করেছি এবং আমার পক্ষ থেকে বিশেষ ইলম দান করেছি। [সূরা কাহাফ, আয়াত ৬৫]

হযরত মূসা আঃ ও হযরত খিজির আঃ এর ঘটনা সবারই জানা রয়েছে। হযরত খিজির আঃ অনেকগুলো ঘটনা ঘটান, যেগুলো সব ছিলো গায়েবের সাথে সস্পর্কিত। এই গায়েবগুলো আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানত না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সূরা কাহাফের ৬৫ নং আয়াতে বলেছেন, আমি আমার পক্ষ থেকে তাকে বিশেষ ইলম দান করেছি। এখানে বিশেষ ইলম দ্বারা গায়েবের ইলম উদ্দেশ্য।

এ আয়াতের তাফসীরে সকলেই উল্লেখ করেছেন এখানে বিশেষ ইলম দ্বারা গায়েবের ইলম উদ্দেশ্য। কাযী শাওকানী ফাতহুল কাদীরে বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন কিছু গায়েবের সংবাদ দিয়েছেন যা একমাত্র তিনিই জানেন। [ফাতহুল কাদীর, পৃষ্ঠা ৩৯০, বিন্যাসঃ ড. সুলাইমান আল আশরক, প্রকাশনায়ঃ দারুস সালাম রিয়াদ]

ইমাম বাগাভী রহঃ এই আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ আমি তাকে আমার পক্ষ থেকে বিশেষ ইলম শিখিয়েছি অর্থাৎ ইলহামের মাধ্যমে কিছু বাতেনী ইলম শিখিয়েছি। আর খিজির আঃ অধিকাংশ আলেমের মতে নবী ছিলেন না। [মায়ালিমুত তানজীল, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৫৮৪]

৪) আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেনঃ তিনি তাদের অগ্র ও পশ্চাত সম্পর্কে অবগত। তাঁর ইলমের কোন অংশ কেউ অবগত হতে পারে না, তবে যাকে তিনি ইচ্ছা করেন অবগত করান। [সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৫]

ইমাম বাইহাকী রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ তার ইলমের কোন অংশ কেউ জানে না, তবে যাকে ইচ্ছা তিনি তা জানান অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা তাকে বিশেষ ইলম শিক্ষা দেন। [আল আসমা ওয়াস সিফাত, ইমাম বাইহাকী রহিমাহুল্লাহ পৃষ্ঠা ১৪৩]

ইমাম ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ আল্লাহর ইলমের ব্যাপারে কেউ অবগত হতে পারে না, তবে আল্লাহ তায়ালা কাউকে যদি অবহিত করেন তাহলে সে অবগত হতে পারে। [তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াতের তাফসীর]

৫) আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেনঃ তিনিই অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত। অতএব তিনি তার গায়েবী বিষয় সম্পর্কে কাউকে অবহিত করেন না। তবে তার মনোনীত রাসূল ব্যতীত। সেক্ষেত্রে তিনি তার সামনে ও পেছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন। [সূরা জিন, আয়াত ২৬-২৭]

এ আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ এখানে তিনি বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা দৃশ্য অদৃশ্য সব কিছু জানেন। কোন সৃষ্টি তাঁর কোন ইলম সম্পর্কে জানতে পারে না, তবে যাকে তিনি জানান কেবল সেই জানতে পারে। [তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৮৪]

ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আমাদের আলেমগণ বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা কুরআনের অনেক আয়াতে গায়েব সম্পর্কিত জ্ঞানকে নিজের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। তবে তাঁর নির্বাচিত বান্দাদেরকে কিছু গায়েবের সংবাদ দিয়ে থাকেন। সুতরাং একমাত্র আল্লাহর নিকটই গায়েবের ইলম রয়েছে। গায়েবের ইলম পর্যন্ত পৌছার রাস্তা সম্পর্কে তিনিই পরিজ্ঞাত। তবে তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে গায়েব সম্পর্কে অবহিত করেন, যাকে ইচ্ছা তার থেকে গোপন রাখেন। [তাফসীরে কুরতুবী, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ২]

ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ ফাতহুল বারীতে লিখেছেনঃ কুরআনের স্পষ্ট নস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, হযরত ঈসা আঃ তারা কী খায় ও সঞ্চয় করে সে সম্পর্কে বলেছেন এবং হযরত ইউসুফ আঃ তাদের খাদ্যের ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। গায়েব সংক্রান্ত এ বিষয়গুলো অবহিত হওয়ার বিষয়টি পবিত্র কুরআনের এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, তিনিই গায়েব সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। তিনি কারও সম্মুখে গায়েব প্রকাশ করেন না, তবে তার নির্বাচিত রাসূল ব্যতীত। কেননা এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, রাসূলগণ কিছু গায়েব সম্পর্কে অবহিত। আর রাসূলের অনুসারী ওলীগণ তাদের কারণেই কিছু গায়েব সম্পর্কে অবহিত হন এবং তাদের মাধ্যমেই সম্মানিত হন। রাসূল ও ওলীর কিছু গায়েব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো রাসূল ওহী পাঠানোর সবগুলো পদ্ধতির মাধ্যমে গায়েব সম্পর্কে অবহিত হন, আর ওলী শুধু স্বপ্ন বা ইলহামের মাধ্যমে গায়েব সম্পর্কে অবহিত হন। [ফাতহুল বারী, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৫১৪]

কাযী শাওকানী তাফসীরে ফাতহুল কাদীরে লিখেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা কোন কোন বান্দাকে কিছু কিছু গায়েব সম্পর্কে অবহিত করে থাকেন। [ফাতহুল কাদীর, কাযী শাওকানী, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২০]

তাফসীরে বায়যাবীতে এসেছেঃ ফেরেশতাদের মাধ্যমে গায়েব অবহিত হওয়ার বিষয়টি রাসূলগণের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ওলীগণ কিছু কিছু গায়েব সম্পর্কে অবহিত হয়ে থাকেন ইলহামের মাধ্যমে। [তাফসীরে বায়যাবী, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩৬৪]

সংক্ষিপ্ত কথা হলো, গায়েবের চাবিকাঠি একমাত্র আল্লাহর নিকট। তিনি ছাড়া কেউ গায়েব জানে না। তবে ফেরেশতা, নবী রাসূল, ওলী ও অন্যান্যদেরকে যদি আল্লাহ তায়ালা গায়েব সম্পর্কে অবহিত করান তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে যতটুকু জানান, তারা কেবল ততটুকুই জানতে পারেন।

Source: https://umarbinkhattab.medium.com/

No comments:

Post a Comment